মূল রচনায় যাইবার পূর্বেই আপনাদিগকে একটি গল্প বলিয়া নেই। সে অনেক কাল পূর্বের কথা। তৎকালে বর্তমানের ন্যায় আগ্নেয়াস্ত্র, আধুনিক যানবাহন কিছুই আবিষ্কৃত হয় নাই। পদযুগলই একমাত্র ভরসা ছিল এক স্থান হইতে অন্যত্র গমন করিবার। ঈদৃশ কালে একদল ব্যক্তি যাইতেছিলেন এক শ্বাপদস্বঙ্কুল জঙ্গলের মধ্য দিয়া। উক্ত জঙ্গল বাঘ-ভাল্লুকের জন্য অতি কুখ্যাত ছিল। প্রায়শই সেখানে উহাদের দেখা মিলিত। তো ভ্রমনকারী দলে দুইজন ব্যক্তির নিকট যথেষ্ট মূল্যবান কিছু স্বর্ণালঙ্কার ছিল। তাহারা দেখিলেন যে গতিতে তাহারা অগ্রসর হইতেছেন তাহাতে গন্তব্যে পৌছাইবার পূর্বেই সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিবার সম্ভাবনা প্রবল। ইহাতে তস্করের হাতে পড়িয়া না আবার স্বর্ণালঙ্কার হারাইতে হয়? এরূপ পরিস্থিতি বিবেচনা করিয়া তাহারা দুইজন দ্রুত অগ্রসর হইবার বন্দোবস্ত করিলেন। কিয়ৎক্ষন গত হইতে না হইতেই তাহারা দুইজন যথেষ্ট আগাইয়া গেলেন এবং সমগ্র দলকে পিছনে রাখিয়া গন্তব্যের খুব কাছাকাছি চলিয়া গেলেন ক্ষুদ্র সময়ের ব্যাবধানে। তাহারা যারপরনাই আনন্দিত হইয়া নিজেদের মধ্যে আলোচনা করিতে লাগিলেন, পশ্চাতে যাহারা পড়িয়া আছেন তাহারা নির্ঘাত আজ ব্যাঘ্রের কবলে পড়িয়া প্রাণ হারাইবেক। ইহা বলিতে না বলিতেই তাহারা দেখিলেন তাহাদের সামনে এক বৃহদাকৃতির ব্যাঘ্র আসিয়া উপস্থিত। উহাকে দেখিয়াই আন্দাজ করা যাইতেছিল যে, ক্ষুধার্ত হইয়া সে শিকারের অণ্বেষনে বাহির হইয়াছে। সামনে এরূপ ব্যাঘ্র দেখিয়া অগ্রগামী ব্যক্তিদ্বয় যারপরনাই ভীত হইয়া উঠিলেন এবং তাহারা কোনরূপ কর্ম নির্ধারনের পূর্বেই ব্যাঘ্র তাহাদের বধ করিয়া ক্ষুধার জ্বালা মিটাইয়া উক্ত স্থান পরিত্যাগ করিল। পড়িয়া রহিল ব্যক্তিদ্বয়ের পরিধেয় পোশাক এবং তাহাদের আহরিত স্বর্ণালঙ্কারসমূহ। অন্যদিকে পশ্চাতে পড়িয়া থাকা দল এক স্থানে তাঁবু খাটাইয়া রাত্রি যাপন করিয়া উষালগ্নে আবার যাত্রা শুরু করিল। পথিমধ্যে তাহারা উক্ত ব্যক্তিদ্বয়ের কাপড় এবং স্বর্ণালঙ্কার পাইয়া গেল। তাহারা তখন স্বর্ণালঙ্কারসমূহ নিজেদের মধ্যে বাটোয়ারা করিয়া পুনরায় গন্তব্যের দিকে যাত্রা করিলেন। আর ইহা হইতেই “আগে গেলে বাঘে খায়, পিছে গেলে সোনা পায়” বাগধারাটির উৎপত্তি হইলো।

যাহা হোক, উপরের গল্পটি সম্পূর্নরূপেই বানোয়াট। আমি ইহা আপন মনের মাধুরী মিশাইয়া ফাদিয়া বসিয়াছি। কিন্তু ইহার অন্তরালের ঘটনা এরূপই কিছু হইবে বলিয়া আমার বিশ্বাস। এখন পাঠক হয়তো ভাবিতেছেন হঠাৎ করিয়া আমি আপনাদিগকে বাগধারার শানে নযুল কেন ব্যাখ্যা করিতেছি, বলিতেছি তাহা এখনই। আজিকে এক ঘটনার কারনে আমরা হঠাৎ করিয়া এক বৃহদাকৃতির দল হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছি। আমরা গুটিকতক অর্বাচিন ভাবিতেছিলাম ইহাতে আমাদিগের অবস্থাও তো ওই বাঘে খাওয়া দুই ব্যক্তির ন্যায় হইয়া যাইবে। ভবিষ্যতে যখন ব্যাঘ্র আসিয়া আমাদিগের উপর হামলা চালাইবে তখন তো পিছনে পড়িয়া থাকা দল কিছুই করিবে না অথবা করিতে পারিবে না। কিন্তু না! আমাদিগের মধ্যে থাকা কতিপয় মহাজ্ঞানী-মহাজন আপনার ঈদৃশ ভ্রান্তি দূর করিতে সক্ষম হইয়াছেন। তাহারা বলিবার পড় আমি ভাবিয়া দেখিলাম, বাস্তবিকই আমি তো এরূপ চিন্তা করিয়া দেখি নাই। প্রথমত ব্যাঘ্র হইতেছে বিড়াল গোত্রীয় প্রাণী। আর কে না জানে বিড়াল অত্যন্ত আরামপ্রিয়। সুতরাং ব্যাঘ্রও তাহার ব্যতিক্রম নহে। উহা ভক্ষন করিবার উদ্দেশ্যে আসিলে উহাকে খানিক আদর করিয়া দিলে, বুকে-পিঠে হাত বুলাইয়া দিলে তাহা খুব সহজেই মানিয়া যাইবে (অথবা মানিয়া যাইবার কথা)! সঠিকরূপে তোয়াজ করিলে কে না মানে? অন্যত্র ইহা হইতেছে তৈলমর্দনের যুগ। সুতরাং ইহা ভাবিবার কোন কারনই নাই যে ব্যাঘ্রও ইহার ব্যতিক্রম হইবে। সুতরাং ব্যাঘ্রকে সঠিকরূপে তৈলমর্দন করিতে পারিলেই কেল্লাফতে। ব্যাঘ্র তো আমাদিগকে ভক্ষন করিবেই না বরং ইহাকে ব্যাবহার করিয়া আরো কর্ম সম্পাদন করিয়া লওয়া যাইবে। ঈদৃশ কর্ম সম্পাদনকালে ব্যাঘ্র হয়তো কিঞ্চিত কোপ প্রদর্শন করিয়া দুই একজনকে আচড় দিয়া বসিতে পারে, উহা কোন ব্যাপার না। ভক্ষন যে করিতেছে না ইহাই তো বেশি। এরূপ আরো বিভিন্ন সম্ভাবনা আমাদের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইবে যদি আমরা দলছুট হইয়া আগাইয়া যাই। তখন পিছনে পড়িয়া থাকা দলই বরং আমাদিগের দিকে তাকাইয়া বলিবে,

“আগে গেলে সব পায়, পিছে গেলে ধরা খায়!”