‘মুক্তবুদ্ধি’র চর্চা এবং একজন বোকা মানব
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করিয়াছি তাহা প্রায় আড়াই বৎসর হইয়াছে। সবকিছু সঠিক পথে চলিলে হয়তো দেখা যাইবে আর দেড় কি দুই বৎসরের মাথায়ই আপন নামের শেষে প্রকৌশলী শব্দটি বসাইবার অধিকার অর্জন করিয়া ফেলিব। আহা, কি আনন্দের ব্যাপারই না হইবে তাহা। কিন্তু একটি দুঃখ কিন্তু মনে সবসময়ই তাড়াইয়া বেড়াইবে, তাহা হইলো; এমনই এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্জন করিলাম যেখানে ‘মুক্তবুদ্ধি’র চর্চার কোন সুযোগই নাই। সারাক্ষন সকলেই শুধু পড়িবার কথাই বলে। ইহা কোন কথা হইলো? বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিয়া যদি আপন জ্ঞান চতুর্দিকে বিকশিত করার সুযোগ না’ই পাই তাহা হইলে আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কি সার্থকতা?
ইহাই ভাবিতাম আমি চার-পাঁচদিন পূর্বেও। কিন্তু হঠাৎই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদের কিছু রদবদল ঘটিয়া গেল। ভাবিলাম, দেখা যাক এইবার কি হয়। নতুন ব্যক্তি, নিশ্চয়ই নতুন কিছু করিবেন। আমার ধারনা যে একেবারেই সঠিক তাহা একদিন গত হইতে না হইতেই প্রমান হইয়া গেল। ছাত্রাবাসে দেখিলাম উপাচার্য মহোদয় হইতে বার্তা আসিয়াছে,”আর কোন বাঁধা নাই; এখন সকল ছাত্র ‘মুক্তবুদ্ধি’র চর্চা করিতে পারিবে। আমাদিগের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সঠিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ তৈয়ারি করিতে হইবে।” ইহা জানিয়া আমি যারপরনাই প্রীত হইয়া গেলাম। ভাবিলাম, যাক এইবার বুঝি আমার অপূর্ন সাধ কিঞ্চিত মিটিবে। কেননা কুয়েটের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগীতা বিষয়ক সংগঠন SGIPC এবং আলোকচিত্রী সমিতি KUETPS এই দুইটির প্রতিষ্ঠার সাথেই আমি প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত। এইবার আর পায় কে? প্রতিষ্ঠা যখন করিয়াছি আর ‘মুক্তবুদ্ধি’র চর্চাও যখন উন্মুক্ত, তখন তো এইবার কোমরে দড়ি বাঁধিয়া নামিতে হইবে। শুধু প্রতিষ্ঠা করিলেই কি চলিবে নাকি, তাহাদের শক্ত অবস্থানে লইয়া যাইতে হইবে না। মনে মনে ইহাও ভাবিতেছিলাম, দুই দুইটা ‘মুক্তবুদ্ধি’র চর্চা হয় এমন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন আমি, উপাচার্য খুশি হইয়া আমাকে বিশেষ কোন পুরষ্কার না দিয়া দেন। ইহা ভাবিতে ভাবিতে আমি যখন ছাত্রাবাসের বিভিন্ন কক্ষে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম তখন দেখি বিভিন্নজন বিভিন্ন অপপ্রচার চালাইতেছে এই ‘মুক্তবুদ্ধি’র চর্চার উন্মুক্তকরন লইয়া। মনে মনে ভাবিলাম, এই সকল ছাত্র হইতে দেশ কি পাইবে? ইহারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পন করিয়াছে, অথচ এখনো বাল্যকালের বিদ্যালয়ের মনোভাব ছাড়িতে সমর্থ হয় নাই। হায় কি দুঃখ!
দুঃখিত মন লইয়া আনসারী ভাই এর দোকনে নাস্তা করিতে যাইয়া দেখি এলাহী কান্ড। ছাত্ররা দলে দলে ‘মুক্তবুদ্ধি’র চর্চা করিতে নামিয়া পড়িয়াছে। তাহারা দেখি রীতিমতো মিছিল করিয়া ইহা উদযাপন করিতেছে। ইহা দেখিয়া আমার দুঃখ গায়েব হইয়া গেল। এত মানুষ ‘মুক্তবুদ্ধি’র চর্চা করিতে নামিয়াছে, আর আমি কিনা কিছু কূপমন্ডুক এর কথায় মন খারাপ করিয়া ঘুরিতেছি। কি বোকা আমি!
খানিক সময় মিছিলটি পর্যবেক্ষন করিবার পর বুঝিতে পারিলাম ইহা একটি রাজনৈতিক মিছিল। এইবারে ধন্দে পড়িয়া গেলাম। আমি তো জানতাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কোন কর্মকান্ড চালানো সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। তাহলে এই মিছিল কোন স্পর্ধায় বাহির করিল তাহারা? ছাত্রাবাসে আসিয়া আবার খুজিলাম যে রাজনীতিও কি আমাদিগের বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্মুক্ত করা হইয়াছে নাকি? কিন্তু কিছুই খুজিয়া পাহিলাম না। মনে একটা ক্ষীন সন্দেহ উঁকি দিতেছিল, ইহার সাথে আবার ‘মুক্তবুদ্ধি’ চর্চার কোন সম্পর্ক নাই তো? কালবিলম্ব না করিয়া অন্তর্জাল জগতে আসিয়া উঁকি দিলাম ছাত্র রাজনীতি বিষয়ে। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করিলাম, এই বিষয়ে যাহাই দেখি সব বাংলাদেশ সম্পর্কিত। ইহা আবার কি ব্যাপার? খানিক সময় ইহা লইয়া মাথা খাটাইবার পর মনে হইল যে, রাজনীতিও বোধহয় ‘মুক্তবুদ্ধি’ চর্চারই একটা অংশ। কতিপয় জ্ঞানী ব্যক্তির সহিত আলাপ করিয়া জানিতে পারিলাম যে, রাজনীতি নাকি অতি উচ্চশ্রেনীর ‘মুক্তবুদ্ধি’র চর্চা। আর তাহাতেই সকলে এত আনন্দিত হইয়া ‘মুক্তবুদ্ধি’র চর্চা করিতে ঝাপাইয়া পড়িয়াছে। আবারো আমি যে এক গন্ডমূর্খ, তাহার প্রমান পাইলাম।
ভাবিতেছি আর বিলম্ব করা চলে না। যেহেতু আমি কুয়েটে ‘মুক্তবুদ্ধি’ চর্চার একজন অগ্রনী সৈনিক সেহেতু এক্ষনই নতুন কোন রাজনৈতিক সংগঠন তৈয়ারি করিয়া মাঠে নামিয়া যাইতে হইবে। নতুবা আমার পুরষ্কারটা না অন্য কেহ ছিনাইয়া লইয়া যায়!