Archive for জুন, 2010

বিস্ময়


আসিফ এবার মাত্র নার্সারীতে পড়ে। খুবই চঞ্চল। সারাদিন শুধু হইচই করে কাটায়। ওর মা মুনিরার সারাটা দিনই চলে যায় আসিফ এর পেছনে। আসিফ মাকে যেমন যন্ত্রনা দেয় ঠিক তেমনি ভালোবাসে। মা ওর যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে মাঝে মাঝে বলে বসে, বেশি যন্ত্রনা করলে কিন্তু তোকে এতিমখানায় নিয়ে রেখে আসবো। আসিফ তখন ছুটে এসে মায়ের বুকে মাথা গুজে কাঁদতে শুরু করে।

মুনিরা তখন ওকে সান্ত্বনা দেয়, পাগল ছেলে আমার। তুই হচ্ছিস আমার বুকের ধন। তোকে কি কখনো আমি এতিমখানায় রেখে আসতে পারি। তোকে ছাড়া যে আমি বাঁচতেই পারব না।

মায়ের আশ্বাস পেয়ে খানিকটা শান্ত হয় আসিফ।

আসিফের বাবা রকিব একজন ব্যাবসায়ী। ব্যাবসার খাতিরে তাকে মাঝেমাঝেই ঢাকার বাইরে ছুটতে হয়। আসিফকে দেয়ার মতো সময় সে খুব বেশী বের করতে পারে না। তারপরও চেষ্টা করে অন্তত বন্ধের দিনগুলো ছেলের সঙ্গে কাটাতে। আসিফও মুখিয়ে থাকে সেই দিনগুলোর জন্য। বাবাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। বাবার সাথে বাইরে গেলেই মজা। শুধু যদি বাবাকে একবার বলা হয়, বাবা ওই জিনিসটা চাই, সেটা খেতে ইচ্ছে করছে। বাবা সাথে সাথে তা কিনে দেবে। আসিফের বাবা রকিব মানুষটাও খুবই ভালো। কখনোই ছেলেকে বকাঝকা করেন না। মুনিরা যখন আসিফকে বকাঝকা করেন তখন রকিব হাসতে হাসতে বলেন, বকছ কেন? এই বয়সের বাচ্চারা যদি একটু দুষ্টুমি না করে তাহলে কখন করবে? বাবার আস্কারা পেয়ে আসিফও নতুন উদ্যমে নেমে পড়ে। মুনিরা তখন তার রাগ ঝাড়তে শুরু করেন রকিব এর উপর। রকিব সব কিছু হাসি মুখে শুনে যান।

এভাবেই চলছিল তিন সদস্যের এই ছোট্ট পরিবারের জীবন।

 

মুনিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করলেও এখন পুরোদস্তুর গৃহিনী। আসিফ যে সময়টা স্কুলে থাকে তখন তার করার মতো কিছু থাকে না। তাই টুকটাক হাতের কাজ কিছু করার চেষ্টা করে। রকিব অনেকদিন ধরে যদিও বলছে যে, ঘরে বসে না থেকে চাকরী-বাকরী কিছু কর। তোমার সময়টাও ভালো কাটবে তাছাড়া নিজেও কিছুটা স্বাবলম্বী হতে পারবে। কিন্তু মুনিরা তাতে কান দেয় নি। তার ধারনা চাকরী করলে যদি আসিফ এর প্রতি অযত্ন হয়!

সেদিন আসিফকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরছিল মুনিরা। রাস্তায় হঠাৎই তার ভার্সিটি জীবনের বান্ধবী যুথীর সাথে দেখা হয়ে গেল। ভার্সিটিতে থাকা অবস্থায় দুজনে খুবই কাছের বান্ধবী ছিল। কিন্তু মুনিরার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে আর খুব বেশি যোগাযোগ ছিল না দুজনের মধ্যে। একথা সেকথার পর মুনিরা জানতে পারলো, পাগলীটা বিয়ে করেছে। ভার্সিটিতে থাকতে সবসময় বলতো, বিয়ে আমি জীবনেও করব না। একজন পুরুষ মানুষের সাথে এক বিছানায় থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। আর তাছাড়া পুরুষ মানুষকে কোন বিশ্বাস আছে নাকি। আজ এই মেয়ের সাথে কাল ওই মেয়ের সাথে।

মুনিরা তাই একটু খোঁচা দিয়ে বললো, কিরে, খুব না বলতি জীবনেও বিয়ে করবো না। এখন কেন?

যুথী একটু হেসে উত্তর দেয়, নাহ্‌, জাহিদ অন্য সব পুরুষদের মতো না। অন্য কোন মেয়ের দিকে ও তাকায়ই না। সে কথা বাদ দে। কাছেই আমি নতুন একটা বিউটি পার্লার খুলেছি, চল তোকে নিয়ে যাই।

মুনিরার হাতে কোন কাজ নেই, তাই সে আর আপত্তি করলো না। বিউটি পার্লারে গিয়ে ঢুকতেই দেখতে পেল বেশ সুদর্শন একজন পুরুষ বসে আছে। যুথী পরিচয় করিয়ে দিলো, এই হচ্ছে জাহিদ। মুনিরা মনে মনে প্রশংসা না করে পারলো না। পাগলীটা বেশ হ্যান্ডসাম এক হাসব্যান্ড পেয়েছে। রকিব এর সবদিকই ভালো শুধু গায়ের রংটা একটু ময়লা। সেটা নিয়ে মুনিরার মনে একটা গোপন অতৃপ্তি থাকলেও কখনো কাউকে কিছু বলে নি। কিন্তু যুথীর হাসব্যান্ড জাহিদ সত্যিই একজন পছন্দ হওয়ার মতো ছেলে। পুরনো বান্ধবীর সাথে আড্ডা মেরেই সেদিন আসিফ এর স্কুলের সময়টুকু কাটিয়ে দিল মুনিরা।

পরদিন আসিফকে স্কুলে দিয়ে আবার যুথীর বিউটি পার্লারে যায় মুনিরা। সেদিন যুথী ছিলনা সেখানে। বদলে জাহিদ সবকিছু দেখাশোনা করছিল। জাহিদ এর সাথেই কথা বলে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে দিল মুনিরা।

পরদিন আবারো বিউটি পার্লারে গিয়ে উপস্থিত হলো মুনিরা। আজকেও যুথী ছিল না। জাহিদের সাথেই খানিক সময় গল্প করে কাটিয়ে দিল মুনিরা। এভাবেই চলতে লাগলো বেশ কিছুদিন। প্রায়ই বিউটি পার্লারে যুথী থাকতো না। তখন জাহিদ থাকতো। ওর সাথে কথা বলতে বেশ লাগতো মুনিরার। জাহিদেরও যে বেশ ভালোই লাগতো তা মুনিরা পরিষ্কার বুঝতে পারতো।

 

(আগামী পোস্টে সমাপ্য)

বিশ্বকাপের মাতাল হাওয়া


দীর্ঘ চার বছরের অপেক্ষার পর এসে গেছে ফুটবল বিশ্বকাপ। যথারীতি বিভিন্ন দলের সমর্থকরা তাদের বাড়ির ছাদে লাগিয়েছেন প্রিয় দলের পতাকা। এক্ষেত্রে অবশ্য ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকরাই এগিয়ে। তবে অন্যরাও কম যান না। কিন্তু আমি যতবারই এই পতাকাগুলো দেখি তখন কেমন জানি হতাশ লাগে। কেন আমাদের নিজের দেশের পতাকা না উড়িয়ে অন্য দেশের পতাকা উড়াতে হয়। আমরা কি নিজের দেশের পতাকা আজ বিশ্বকাপ উপলক্ষে গর্বের সাথে উড়াতে পারতাম না? অবশ্যই পারতাম!
আপনারা নিশ্চয়ই এতক্ষনে হাসতে শুরু করেছেন। ভাবছেন আবারো আমি পাগলের প্রলাপ বকছি। কিন্তু সত্যি বলছি, আসলেও এমনটা হতেও পারতো! বিশ্বাস না হলে বাংলাদেশের র‌্যাঙ্কিংটা দেখুন (Bangladesh: FIFA/Coca-Cola World Ranking)। এখানে দেয়া আছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ১১০ (১৯৯৬ সালে)। এবারের বিশ্বকাপে এবং প্রতি বিশ্বকাপেই এমন অনেক দল থাকে যাদের অবস্থান এর কাছাকাছি এবং ১৯৯৬ সালের দিকে তারচেয়েও খারাপ ছিল। তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন এমন হলো? কেন আমাদের ফুটবলের অবস্থা দিনে দিনে উন্নতির বদলে অবনতি হচ্ছে? এর একটা কারন হিসেবে বলা যায় ক্রিকেট এর ব্যাপক আগ্রাসন। ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অংশগ্রহন করার যোগ্যতা অর্জন করার পর থেকে ফুটবল-এ সেই যে ভাটা পরেছে তা আর কাটেওনি, কাটবেও না মনে হয়! আমার এখনো মনে আছে ছোটবেলায় যখন জাতীয় লীগ এর খেলাগুলো হতো তখন মোহামেডান, আবাহনীর সমর্থকদের সেকি উত্তেজনা। অথচ এখন কেউ তার খবরও রাখে না। দুঃখ দুঃখ!!!
যেহেতু আমাদের দেশ বিশ্বকাপ খেলছে না সেহেতু আমরা বিশ্বকাপে অন্য দেশকে সমর্থন দিতেই পারি। কিন্তু তাই বলে তাদের পতাকা কেন উড়াতে হবে, এটা আমার মাথায় ঢুকে না। এতে একদিকে যেমন আমাদের দেশের আইন ভঙ্গ করা হয় অন্যদিকে অন্য আরেকটি দেশের পতাকাকেও অবমাননা করা হয় (কেননা কোন দেশের পতাকাই সঠিক নিয়ম অনুযায়ী বানানো হয় না এবং সব দেশেরই পতাকার ব্যাপারে বেশ কিছু আইন আছে)। সেই সাথে যে পরিমান কাপড় অপচয় করা হয় তার কথা কি আর বলবো! একটা ছোট্ট হিসাব দিই। ধরুন সারা বাংলাদেশে ১ লক্ষ পতাকা উড়ানো হয়েছে, গড়ে প্রত্যেক পতাকার দৈর্ঘ্য ২ গজ, তার মানে প্রায় ২ লক্ষ গজ কাপড়ের কি নির্লজ্জ অপচয়। আমাদের মতো একটা গরিব দেশে এই কথা ভাবতেও কষ্ট হয়।
ঢাকা নিউমার্কেট এ উড়ছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের পতাকা
কিছুদিন আগে জার্মান প্রবাসী আমার এক বোন তার ফেসবুক-এ স্ট্যাটাস দিয়েছে, “কি খেল! আমার ব্রাজিলিয়ান বান্ধবী তার প্রোফাইল এ ব্রাজিল এর ছবি দেয় নি অথচ বাংলাদেশী বান্ধবী ব্রাজিল এর ছবি লাগিয়েছে।” মনে তখন প্রশ্ন এলো, জাতি হিসেবে আমরা কি কখনোই আত্মসম্মানবোধ অর্জন করতে পারব না?
আমি বিশ্বকাপের সবগুলো খেলা না দেখলেও ভালো দলগুলোর খেলা দেখার চেষ্টা করি। একক ভাবে কোন দলের প্রতি আমার তেমন দূর্বলতা নেই, কোন খেলোয়ার এর খেলা ভালো লাগলে তার খেলাটা দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু যখন বিভিন্ন দলের সমর্থকদের (আসলে অন্ধভক্ত) দেখি তখন তাদের জন্য কেমন যেন করুনা হয়। অনেকেই আছে (সবাই নয়) যারা মনে করে তাদের সমর্থিত দল বাদে অন্য দল যেমন খেলতেই জানে না তেমনি তাদের সমর্থকরাও ফুটবল খেলার কিছুই বোঝে না। এক দলের সমর্থকরা অন্য দলের সমর্থকদের সাথে কথার যুদ্ধ থেকে এক পর্যায়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এমন ঘটনা তো আমদের ইতিহাসে আছেই। যে জাতি অন্যদেশের খেলা নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে তারা রাজনৈতিক সংঘর্ষে লিপ্ত হবে এটাতো খুবই স্বাভাবিক। স্কুল এর কোন এক ক্লাসের বাংলা বইয়ে একটা প্রবন্ধ ছিল (নামটা এখন মনে পরছে না), সেখানে লেখক বলেছেন, “একটি উচ্চ জাতির সংস্পর্ষে আসিয়াও আমরা তাহাদের গুনগুলো রপ্ত না করিয়া দোষগুলো আত্মসাৎ করিয়াছি।” এই কথাটা যে কতোটা সত্য তা বিশ্বকাপ এলেই আরো ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়। কেননা সারা পৃথিবীতে ইংরেজদের খেলা নিয়ে সহিংসতা এবং হুলিগান বিখ্যাত আর আমরা কিনা তাই অনুসরন করছি। এ লজ্জা কোথায় রাখি। তবে এর মাঝেও একটা ভালো খবর দিই, টাঙ্গাইলের কোন এক জায়গায় আমার এক বন্ধু দেখেছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা সেলাই করে লাগানো আর তাতে লেখা, “ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থক মৈত্রী সঙ্ঘ”। এটা দেখে মনে তাও কিছুটা আশার সঞ্চার হয় যে, পতাকা হয়তো তারা টাঙিয়েছে কিন্তু তারা যে সংঘর্ষে যাবে না সে ব্যাপারে তারা ঘোষনা দিয়ে রেখেছে।
জানি আমার এই লেখা পড়ে অনেক অন্ধভক্তই হয়তো নাখোশ হবেন কিন্তু আমি তাদেরকে বলবো, আসুন আমরা খেলা দেখি, সবাই মিলে এর মজা নিই, অন্যদের সাথে তর্ক করি কিন্তু তা যেন গঠনমূলক হয় এবং কাউকে আঘাত না করে। নিজের দেশের সম্মান বজায় রাখি, অন্যদেশকেও সম্মান করি। আর সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশকে কি করে বিশ্বকাপে দেখা যায় তার স্বপ্ন দেখি এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করি।

Bookmark and Share

একটি শিক্ষাসফর এর গল্প


অনেকেই হয়তো ভাবছেন এই গরমের মাঝে আবার কিসের শিক্ষা সফর? এখন তো গ্রীষ্মকালীন অবকাশ চলার কথা। কিন্তু শেখার আগ্রহ থাকলে আসলে সবসময়ই শেখা যায়। সেরকমই এক শিক্ষা সফর এর গল্প বলবো আজ।

শুরুতেই একটা ভালো খবর দিয়ে নিই। সম্প্রতি আমার তোলা দুইটি ছবি “North South University” কর্তৃক আয়োজিত “International Inter University Photo Exhibition (IIUPE)”-এ প্রদর্শনের জন্য মনোনীত হয়েছে। তো যাই হোক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ বিধায় আমি আমার টাঙ্গাইলের বাসাতেই ছিলাম। NSU থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হলো ১২ জুন এর মাঝে NSU তে গিয়ে নির্বাচিত ছবির রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে। সত্যি কথা বলতে কি, ঢাকা যেতে আমার খুব বেশি ভালো লাগে না, তার একমাত্র কারন ট্রাফিক জ্যাম। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, কিন্তু তারপরও বলছি, বাংলাবাজার থেকে মহাখালি যেতে আমার সাধারনত সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। সেই রাস্তাই একবার ফাঁকা পেয়ে আমি মাত্র ১৭ মিনিটে পৌছেছিলাম! Ripley’s Believe It Or Not-এ স্থান পাবার মতো ঘটনা। 🙂
যাই হোক, বসুন্ধরায় আমার এক চাচার বাসা থাকার সুবাদে তার বাসায় এক রাত থেকে পরদিন NSU তে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন এর কাজ শেষ করে ভাবলাম ঢাকায় যারা বন্ধু-বান্ধব আছে তাদের সাথে দেখা না করে গেলে কেমন হয়। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত আপন এক বড় ভাই কিছুদিন হলো চাকরী পেয়েছেন (মাহমুদ ফয়সাল ভাই) তার সাথেও দেখা করা দরকার (ঘাড় ভেঙ্গে তো কিছু আদায় করতে হবে :D)। তো সেই উদ্দেশ্যে আমি যখন বিশ্বরোড থেকে শাহ্‌বাগ এর দিকে রওয়ানা দিলাম তখন ঘড়িতে বাঁজছে সকাল ১০:১৫ আর শাহ্‌বাগ গিয়ে পৌছালাম দুপুর ১২:৩৯ এ। বাসে একজন আবার তার মোবাইলে কাকে যেন বলছিল, “আজ রাস্তায় জ্যাম একটু কম আছে!” আহা কি আনন্দদায়ক ব্যাপার! এইটুকু রাস্তা আসতেই কত শিক্ষা পেয়ে গেলাম। পাঠক হয়তো ভাবছেন কি শিক্ষা? সেটা হলো এই দেশে থাকা যাবে না। অনেকেই হয়তো আমার এই কথায় হা হা করে উঠবেন। তোমার মতো শিক্ষিত ছেলেরা যদি বাইরে চলে যায় তাহলে দেশের উন্নতি কারা করবে? তাদের কে আমি বলবো, দেশের সবকিছু এখন ঢাকা কেন্দ্রিক। আর তার ফলাফল হচ্ছে আজকের এই ঢাকা। ছোট বেলায় পড়া পাঁচটি মৌলিক চাহিদার চারটিই (বাসস্থান এর চাহিদা ঢাকার আর পূরন করার ক্ষমতা নেই) এখন ঢাকা ছাড়া অন্য কোথাও আর পূরন করার সেরকম সুযোগ নেই (অথবা ততোটা ভালো সুযোগ নেই)। কিন্তু যে শহরে ৩০ মিনিটের রাস্তা যেতে ৩ ঘন্টা লাগে সেই শহরে থেকে দেশের কী উন্নতি করা সম্ভব?

জ্যামহীন রাস্তা

এরকম জ্যামহীন রাস্তা ঢাকাবাসীর জন্য এখন ধূসর অতীত

আমি নিজে হয়তো এখন বলছি যে, ঢাকায় আমার অসহ্য লাগে। কিন্তু পাশ করে বের হবার পর আমাকে হয়তো সেই ঢাকাতেই যেতে হবে কর্মসংস্থান এর আশায়। শুধু কর্মসংস্থান নয়, আমি যদি উচ্চশিক্ষা গ্রহন করতে বিদেশ যেতে চাই তাহলেও সেই ঢাকাতেই সব কাজ করতে হবে। কিন্তু এরকম কেন হবে? পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তারা কখনো দেশের সবকিছু এক শহর কেন্দ্রিক করে ফেলে না। সব সুবিধাই বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হয়তো এই শহরের শিক্ষার মান ভালো তো আরেক জায়গায় চিকিৎসা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে চিকিৎসা নিতে অই শহরটিতে না গেলে চলবেই না। কিছুদিন আগে “প্রথম আলো’”-তে  এই নিয়ে একটি চমৎকার আর্টিকেল (এক-নগরের দেশ হয়ে বাঁচবে বাংলাদেশ?) ছাপা হয়েছিল। পাঠকরা না পড়ে থাকলে পড়ে দেখতে পারেন।

তাই বলছি, এখনই যদি নাগরিক সুযোগ সুবিধা শুধুমাত্র ঢাকা কেন্দ্রিক না করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাবস্থা না করা হয় তাহলে খুব শীঘ্রই সুপ্রিম কোর্ট হয়তো “কেন ঢাকাকে পরিত্যক্ত নগরী হিসেবে ঘোষনা দেয়া হবে না” এই মর্মে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে পনের দিনের মধ্যে কারন দর্শানোর আদেশ পাঠাতে পারেন!

শেষ পর্যন্ত আমি শাহ্‌বাগ থেকে আর কোথাও যাবার সাহস করি নি। সেখানেই এক বন্ধুর সাথে দেখা করে ঢাকা থেকে রীতিমতো পালিয়ে এসেছি আর বাসায় ফিরে হতাশ হয়ে ফেসবুক এ স্ট্যাটাস দিয়েছি,

“যে ঢাকা যেতে বলে, সে আপনার বন্ধু নয়!”

কি আর করবো বলুন?

Bookmark and Share

‘ফেসবুক’ বন্ধ; আরও একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ


সম্প্রতি বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি বুনটস্থান; ‘ফেসবুক’ বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। জনমনে ইহা লইয়া যারপরনাই ক্ষোভ পরিলক্ষিত হইতেছে। অধিকাংশই (সকলেই নয়) বলিতেছেন ইহা কিরূপ কর্ম হইল। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়িবার প্রতিশ্রুতি দিয়া ক্ষমতারোহন করিয়া এখন ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যমকেই রুদ্ধ করিয়া দিতেছে! সরকারের ‘ফেসবুক’ বন্ধের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদশের face এ যে কালিমা পড়িল এবং যে সকল ফ্যাসাদ হইল তাহা সরকার কিরূপে মোচন করিবে? ইহা তো আরেকটি মৌলবাদী দেশের (নাম উল্লেখ করিতে চাহিতেছি না) ন্যায় হইয়া গেল। ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমার মনে হয় জনগন আরো একটি বার সরকারকে ভুল বুঝিয়াছেন। সরকার সর্বদাই দেখিয়া আসিতেছে কিসে জনগনের মঙ্গল হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ এর স্বপ্ন সহজে বাস্তবায়ন করা যায়। সে লক্ষ্যে যে সরকার এক কালজয়ী সিদ্ধান্ত গ্রহন করিয়াছে তাহা আমি আমার পূর্বের রচনাতে উল্লেখ করিয়াছি। অত্র রচনাতেও ডিজিটাল বাংলাদেশ এর সেই স্বপ্ন নিয়ে আরো কিছুটা আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা দেখিতেছি।

গত ১৫ই জৈষ্ঠ্য (২৯ মে) যখন ‘ফেসবুক’ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় তখন আমি রেলগাড়িতে অবস্থান করিতেছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই আমি ‘ফেসবুক’ বন্ধের ব্যাপারে অবগত ছিলাম না। কিন্তু কিছুক্ষন এর মাঝেই আমি আমার ভ্রাম্যমান দূরালাপনীতে বেশ কয়েকটি ক্ষুদে বার্তা পেয়ে গেলাম, বাংলাদেশে ‘ফেসবুক’ বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে এই বিষয়ে। অনেকেই আমার সহিত যোগাযোগ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এখন কি হইবে? আমি তখন মুচকি হাসি দিয়া বলিয়াছিলাম, ইহা কোন ঘটনা হইল। সরকার চলে ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। ‘ফেসবুক’ এ প্রবেশ করা তো কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু বাড়িতে আসিয়া আপন গণনাযন্ত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ছলচাতুরী করিয়া যখন ‘ফেসবুক’ এ প্রবেশ করিতে সক্ষম হইলাম তখনই আমি বুঝিতে পারিলাম কি ভুল উক্তিটাই না আমি করিয়াছিলাম! আসলে হইবে আমি চলি পাতায় পাতায় আর সরকার চলে শিরায় শিরায়। কেন? কারন ‘ফেসবুক’ এ প্রবেশ করিয়া দেখি আমার বেশ কিছু বন্ধু (যাহারা বাংলাদেশেই অবস্থান করিতেছে) সেখানে উপস্থিত। এর মাঝে সকলেই যে প্রযুক্তি বিষয়ে যথেষ্ঠ দক্ষ তাহা নয়। তাহলে? তখনই বুঝিতে পারিলাম আসলে সরকার কি করিতে চাহিতেছে। যদিও আমার অগ্রজ এক ভ্রাতা এই বিষয়ে সামান্য আভাষ দিয়াছেন ‘ফেসবুক’ এ, কিন্তু আমি এখানে তাহা কিঞ্চিত বিস্তারিত লিখিতেছি।

যখন অন্তর্জালে কোনকিছু আটকাইয়া দেওয়া হয় তখন তাহা ব্যাবহার করিতে চাহিলে bypass (বিকল্প পথ) করিতে হয়। এই বিকল্প পথের ব্যাপারটি কিঞ্চিত জটিল, বিশেষ করিয়া যাহাদের প্রযুক্তি জ্ঞান তুলনামূলক কম তাহাদের জন্য ইহা প্রায় অসাধ্য। এই কর্মে সবচেয়ে প্রচলিত ব্যাবস্থাটি হইতেছে, proxy ব্যাবহার করা। যাহাদের প্রযুক্তি জ্ঞান সীমিত তাহারা তো বটেই, যথেষ্ঠ প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন অনেকেও এই বিষয়ে অবগত নন। কিন্তু একটি কথা, প্রয়োজন কোন আইন মানে না। জনগনও এখানে কোন আইনের তোয়াক্কা না করিয়া শিখিয়া লইয়াছে এই জটিল ব্যাপারগুলো। আর তাহার ফল; সকলেই ‘ফেসবুক’ ব্যাবহার করিতেছে, কিন্তু একটু ভিন্ন পন্থায়। ইহাতে বেশ কয়েকটি লাভ হইল; এক, যাহারা ‘ফেসবুক’ চিনিত না তাহারা চিনিয়া ফেলিল পত্রিকার সংবাদ এর সুবাদে, দুই, যাহারা ‘ফেসবুক’ ব্যাবহার করেন তাহারা নতুন একটি প্রাযুক্তিক বিষয় সম্পর্কে অবগত হইল, তিন, যাহারা proxy ব্যাবহার করিয়া ‘ফেসবুক’ এ প্রবেশ করিয়াছেন; তাহারা অন্য কোন দেশের ‘ফেসবুক’ এর মাধ্যমে প্রবেশ করিয়াছেন যাহাদের অনেকেরই প্রধান ভাষা ইংরেজী নয় (যেমন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইউক্রেন)। সেই সুবাদে সেই দেশের ভাষা সম্পর্কেও খানিকটা জানা হইয়া গিয়ছে। আপাতত আমি এক ঢিলে তিন পক্ষী দেখিতেছি, কিন্তু আমার বিশ্বাস সরকার এক ঢিলে শতশত পক্ষী মারিয়াছে, যাহা আপন ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আসিতেছে না।

এখন পাঠক প্রশ্ন করিতে পারেন, তা সরকার যখন শিখাইতেই ইচ্ছুক তখন এইরূপে কেন? অন্যভাবে কি পারা যাইত না? এইখানে আমার একটি গদ্যের কথা মনে পড়িতেছে। ইহা হয়তো অনেকেই শুনিয়াছেন, তথাপিও বলিতেছি।

দুই ফাঁকিবাজ ভ্রাতাকে পড়াইবার দায়িত্ব লইয়াছেন এক শিক্ষক। তিনি বিভিন্ন প্রকারে চেষ্টা করিয়া যখন কোনভাবেই তাহাদের পাঠদান করিতে সক্ষম হইলেন না তখন তিনি বুদ্ধি করিয়া ভ্রাতাদ্বয়কে ফুলবাগানে বেড়াইতে লইয়া গেলেন। খানিক হাওয়া খাইবার পর তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে বলিলেন, ওই বৃক্ষটিতে কইটি ফুল আছে কহিতে পারো? জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উত্তরে কহিল, তিনটি। তখন শিক্ষক তাহাকে বলিলেন, বৃক্ষটিতে যদি আরো দুইটি ফুল ফুটে তাহা হইলে কয়টি হইবে কহিতে পারো? সাথে সাথে কনিষ্ঠ ভ্রাতা চিৎকার দিয়া উঠিল, দাদা উত্তর দিস্‌ না কিন্তু। মাস্টারমশাই আমাদিগকে গণিত শিখাইবার চেষ্টা করিতেছেন।

আমাদিগের অবস্থাও হইয়াছে ওই ফাঁকিবাজ ভ্রাতাদ্বয়ের ন্যায়। আমরা কোন ক্রমেই আর শিক্ষা গ্রহন করিতে চাহি না। তাই সরকার এই প্রচেষ্টা লইয়াছিল বলিয়া আমার বিশ্বাস। সৌভাগ্যক্রমে জনগন এই ফাঁকিটি ধরিতে না পারিয়া শিক্ষাগ্রহন করিয়া ফেলিয়াছে। আহা! জনগনকে লইয়া এতো চিন্তা করে এমন সরকার পৃথিবীর আর কোন দেশে খুজিয়া পাওয়া যাইবে? ইহা ভাবিয়াই আনন্দে আর গর্বে বুক একশ হাত ফুলিয়া উঠিতেছে। সাধেই কি আর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলিয়াছিলেন,

“সাবাস্‌ বাংলাদেশ; পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়

জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার; তবু মাথা নোয়াবার নয়।”


Bookmark and Share