Posts from the ‘ছোটগল্প’ Category

বিস্ময় (শেষাংশ)


(প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করছি এতোটা দেরি করার জন্য। বিভিন্ন ব্যস্ততার জন্য এতদিন গল্পটির শেষ অংশটুকু দিতে পারি নি)

রকিব ব্যাবসয়ার খাতিরে বেশির ভাগ সময়ই বাইরে থাকে, সুতরাং মুনিরা স্ত্রী হিসেবে তার কাছ থেকে যে সময়টুকু আশা করে তা বেশির ভাগ সময়ই সে পায় না। সে ক্ষেত্রে অন্য কোন সুদর্শন পুরুষ মানুষ এর প্রতি তার আকৃষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। মুনিরা বুঝতে পারলো যে সে ধীরে ধীরে জাহিদ এর প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। যদিও সে মনকে বারবার প্রবোধ দেবার চেষ্টা করছিল যে, এটা অন্যায়। কিন্তু কেন যেন মন তা মানছিল না। মুনিরা যখন এই মানসিক দ্বন্দে ভেবেই পাচ্ছিল না কি করবে তখনই একদিন জাহিদ এর কাছ থেকে প্রস্তাবটা এল।

সেদিন ছিল মঙ্গলবার। আসিফকে স্কুলে রেখে এসে মুনিরা বরাবরের মতোই যুথীর পার্লারে গিয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখে জাহিদ বসে আছে। মুনিরাকে দেখেই সে বলল, আরে আসুন আসুন, আপনার কথাই ভাবছিলাম।

মুনিরা অবাক হবার ভান করে বলল, কেন, আমার কথাই ভাববেন কেন? ঘরে সুন্দরী বউ আছে, কিন্তু তারপরও কি মনে করে আমার কথা?

জাহিদ খানিক হেসে উত্তর দিল, সে যাকগে। চলুন কোথাও বসে একটু চা খেয়ে আসি।

মুনিরাও সানন্দে রাজি হয়ে যায়। জাহিদ চা খাবার কথা বলে নিয়ে গেল এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। সেখানকার মৃদু আলোতে এম্নিতেই সবকিছু কেমন যেন রহস্যময় লাগে, তার উপর বিভিন্ন টেবিলে জুটি বেধে বসে আছে আজকালকার ছেলে-মেয়েরা। মুনিরা এদের দেখে কেমন যেন লজ্জা পেয়ে যায়। এখানে উপস্থিত কেউই যে স্বামী-স্ত্রী না তা দেখেই বোঝা যায়। সে নিজে একজন বিবাহিতা নারী, সেও এসেছে অন্য এক পুরুষের সাথে। এই ভেবেই সে যেন কেমন অস্বস্তি বোধ করছিল। জাহিদ তাকে নিয়ে কোনার এক টেবিলে গিয়ে বসলো। ওয়েটারকে দু’কাপ কফি দেবার কথা বলে মুনিরার সাথে বিভিন্ন কথা বলতে লাগলো। হঠাৎ করেই সে মুনিরাকে বলে বসলো, মুনিরা আমি তোমাকে ভালবাসি।

মুনিরা চমকে উঠে জাহিদ এর দিকে তাকালো। জাহিদ এসব কি কথা বলছে? মুনিরার নিজের মনের মাঝেও একথা ছিল। জাহিদও যে তাকে পছন্দ করতো তাও সে বেশ বুঝতে পারতো। তাই বলে সরাসরি ভালবাসি বলে ফেলবে?

জাহিদ মুনিরার হাত ধরে বললো, মুনিরা আমি জানি তুমিও আমাকে ভালবাস। বল, বাস না?

ঘটনার আকস্মিকতায় মুনিরা কেমন যেন স্থবির হয়ে গেছে। সে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে, সেও মন থেকে জাহিদকে চায়।

দুদিক থেকেই সম্মতি থাকায় তাদের মাঝে আর কোন বাধা থাকে না। যদিও দুইজনেই বিবাহিত কিন্তু সে কথা ভুলে গিয়ে দুজনেই প্রেমে মত্ত হয়ে ওঠে। আগে মুনিরার বাসায় জাহিদের যাতায়াত ছিল না, এখন সেটাও প্রায় নিয়মিত হয়ে দাড়িয়েছে। মুনিরার বাসা বেশির ভাগ সময় খালিই থাকে। তাই তেমন কোন সমস্যাও নেই।

সেদিন রবিবার ছিল। রকিব কি একটা কাজে নারায়নগঞ্জ গিয়েছিল। তার ফিরতে ফিরতে তিনদিন লেগে যাবে। আসিফের সামান্য জ্বর এসেছিল। সে স্কুলে যায় নি। বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে ছিল। এসময় হঠাৎ জাহিদ এসে হাজির। মুনিরারও একা একা ভালো লাগছিল না, মনে মনে তাই জাহিদকে এই মূহুর্তে আশা করছিল। ড্রইং রুমে বসে গল্প করতে করতেই জাহিদ মুনিরার সাথে বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে বসে। এতদিন ধরে তাদের সম্পর্ক চলছে। এর মাঝে তা যথেষ্ঠই গভীরতা পেয়েছে। সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ এর সীমাও তারা বহুবারই ছাড়িয়ে গিয়েছে। এতদিন জাহিদ যখন আসত তখন বাসা খালিই থাকত, আজ যদিও আসিফ বাসায় আছে। কিন্তু সে ঘুমিয়ে আছে ভেবে মুনিরা সেই চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিল। এর মাঝেই তারা যথেষ্ঠ অন্তরঙ্গ হয়ে পড়লো। হঠাৎই জাহিদের হাতের ধাক্কায় সোফার পাশের টেবিল থেকে একটা পিতল এর শোপিস পড়ে যায়। ঝনঝন শব্দ করে ওঠে তাতে। কিন্তু ওইদিকে খেয়াল করার কোন সময়ই নেই তখন তাদের।

অন্যদিকে শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় আসিফের। সে মাকে ডাকতে গিয়েও কি মনে করে যেন ডাকল না। বিছানা থেকে উঠে মাকে খুজতে গেল। খুজতে খুজতে ড্রইং রুমে এসে মাকে এই অবস্থায় দেখে সে হতভম্ব হয়ে যায়। সে তার ছোট্ট জীবনে কখনো এ ধরনের ঘটনার সম্মুখিন তো কখনো হয়ই নি সেইসাথে নিজের মাকে এই অবস্থায় দেখে সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। তার এখন কি করা উচিৎ তা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না।

হঠাৎই দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আসিফের দিকে চোখ যায় মুনিরার। চমকে লাফ দিয়ে উঠে কাপড় ঠিক করে নেয় সে। লজ্জায় সে তখন থরথর করে কাঁপছে। সেইসাথে একটা অজানা ভয়ও তাকে গ্রাস করছে। লজ্জায়, অপমানে, ভয়ে মুনিরার মাথা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায় তখন। সে ভাবে এই মূহুর্তে আসিফকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ছুটে গিয়ে সে আসিফকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসে।

ড্রইং রুমে এসে সে কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে জাহিদের দিকে তাকায়। জাহিদ নিজেও বিপদ খানিকটা আঁচ করতে পারছিল। এ খবর যদি কোন ভাবে যূথী অথবা রকিবের কানে যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। যূথী তাকে একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে মানে। কিন্তু আসলে তা একেবারেই ভুল। আসিফের অভ্যাসই হচ্ছে পরকীয়া করে বেড়ানো। মুনিরার আগেও সে আরও দুইজনের সাথে এভাবে মিলিত হয়েছিল। অবশ্য শুধু পরকীয়ার আনন্দের জন্যই যে সে এমনটা করে তা বললে ভুল হবে। অর্থও এখানে একটা ভূমিকা রাখে। কেননা সে যাদের যাদের সাথে পরকীয়া করেছে, তারা সকলেই তার থেকে তূলনামুলক ভাবে ধনী। কিন্তু কখনোই এমন বিপদে পড়ে নি সে। আজকে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য কি করা যায় তা দ্রুত ভাবতে লাগলো সে। প্রথমেই মাথায় এল আসিফকে একেবারে সরিয়ে ফেলা। কিন্তু পরমূহুর্তে ভাবলো, একেবারে বাচ্চা মানুষ; আগে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করা যাক। তারপর যদি না বোঝে তাহলে বালিশ চাপা দিয়ে দুই মিনিট ধরলেই হবে। সে মুনিরার দিকে তাকিয়ে বললো, চল দেখি ওকে ব্যাপারটা বুঝানোর চেষ্টা করি। তারপর দেখা যাক কি করা যায়।

মুনিরা কোন কথা না বলে চুপ করে দাড়িয়ে রইল। তার মাথায় তখন কিছুই ঢুকছিল না। জাহিদ তাকে ধরে নিয়ে আসিফের ঘরে এসে উপস্থিত হয়। আসিফ তখনো চোখ খুলে শুয়ে আছে। তাকে কেমন যেন মৃত মানুষের মতো দেখাচ্ছিল। বিস্মিত চোখে সে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। জাহিদ তার কাছে গিয়ে দাড়ানোর পরও তার মাঝে কোন ভাবান্তর হলো না। জাহিদ আস্তে করে আসিফের পাশে বসলো, একবার মুনিরার দিকে তাকালো, তারপর আসিফের দিকে তাকিয়েই খানিকটা চমকে উঠলো। দেখলো আসিফের গলার কাছে দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ। ঠোটের কোঁনা দিয়েও খানিক রক্ত বের হয়ে এসেছে। এরকম কিছু সে ভাবতেই পারে নি। সে একবার আসিফের বুকের উপর হাত রাখলো, তারপরেই নিশ্চিত হয়ে গেল। জাহিদ অবাক হয়ে মুনিরার দিকে তাকালো। সে তখনো অপ্রকৃতিস্থের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তারপর মাথা ঘুরিয়ে আসিফের দিকে তাকালো। নিথর হয়ে পড়ে আছে আসিফ। তার চোখ দুটো তখনো খোলা।  প্রাণহীন সে চোখে তখনো রাজ্যের বিস্ময়।

Bookmark and Share

বিস্ময়


আসিফ এবার মাত্র নার্সারীতে পড়ে। খুবই চঞ্চল। সারাদিন শুধু হইচই করে কাটায়। ওর মা মুনিরার সারাটা দিনই চলে যায় আসিফ এর পেছনে। আসিফ মাকে যেমন যন্ত্রনা দেয় ঠিক তেমনি ভালোবাসে। মা ওর যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে মাঝে মাঝে বলে বসে, বেশি যন্ত্রনা করলে কিন্তু তোকে এতিমখানায় নিয়ে রেখে আসবো। আসিফ তখন ছুটে এসে মায়ের বুকে মাথা গুজে কাঁদতে শুরু করে।

মুনিরা তখন ওকে সান্ত্বনা দেয়, পাগল ছেলে আমার। তুই হচ্ছিস আমার বুকের ধন। তোকে কি কখনো আমি এতিমখানায় রেখে আসতে পারি। তোকে ছাড়া যে আমি বাঁচতেই পারব না।

মায়ের আশ্বাস পেয়ে খানিকটা শান্ত হয় আসিফ।

আসিফের বাবা রকিব একজন ব্যাবসায়ী। ব্যাবসার খাতিরে তাকে মাঝেমাঝেই ঢাকার বাইরে ছুটতে হয়। আসিফকে দেয়ার মতো সময় সে খুব বেশী বের করতে পারে না। তারপরও চেষ্টা করে অন্তত বন্ধের দিনগুলো ছেলের সঙ্গে কাটাতে। আসিফও মুখিয়ে থাকে সেই দিনগুলোর জন্য। বাবাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। বাবার সাথে বাইরে গেলেই মজা। শুধু যদি বাবাকে একবার বলা হয়, বাবা ওই জিনিসটা চাই, সেটা খেতে ইচ্ছে করছে। বাবা সাথে সাথে তা কিনে দেবে। আসিফের বাবা রকিব মানুষটাও খুবই ভালো। কখনোই ছেলেকে বকাঝকা করেন না। মুনিরা যখন আসিফকে বকাঝকা করেন তখন রকিব হাসতে হাসতে বলেন, বকছ কেন? এই বয়সের বাচ্চারা যদি একটু দুষ্টুমি না করে তাহলে কখন করবে? বাবার আস্কারা পেয়ে আসিফও নতুন উদ্যমে নেমে পড়ে। মুনিরা তখন তার রাগ ঝাড়তে শুরু করেন রকিব এর উপর। রকিব সব কিছু হাসি মুখে শুনে যান।

এভাবেই চলছিল তিন সদস্যের এই ছোট্ট পরিবারের জীবন।

 

মুনিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করলেও এখন পুরোদস্তুর গৃহিনী। আসিফ যে সময়টা স্কুলে থাকে তখন তার করার মতো কিছু থাকে না। তাই টুকটাক হাতের কাজ কিছু করার চেষ্টা করে। রকিব অনেকদিন ধরে যদিও বলছে যে, ঘরে বসে না থেকে চাকরী-বাকরী কিছু কর। তোমার সময়টাও ভালো কাটবে তাছাড়া নিজেও কিছুটা স্বাবলম্বী হতে পারবে। কিন্তু মুনিরা তাতে কান দেয় নি। তার ধারনা চাকরী করলে যদি আসিফ এর প্রতি অযত্ন হয়!

সেদিন আসিফকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরছিল মুনিরা। রাস্তায় হঠাৎই তার ভার্সিটি জীবনের বান্ধবী যুথীর সাথে দেখা হয়ে গেল। ভার্সিটিতে থাকা অবস্থায় দুজনে খুবই কাছের বান্ধবী ছিল। কিন্তু মুনিরার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে আর খুব বেশি যোগাযোগ ছিল না দুজনের মধ্যে। একথা সেকথার পর মুনিরা জানতে পারলো, পাগলীটা বিয়ে করেছে। ভার্সিটিতে থাকতে সবসময় বলতো, বিয়ে আমি জীবনেও করব না। একজন পুরুষ মানুষের সাথে এক বিছানায় থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। আর তাছাড়া পুরুষ মানুষকে কোন বিশ্বাস আছে নাকি। আজ এই মেয়ের সাথে কাল ওই মেয়ের সাথে।

মুনিরা তাই একটু খোঁচা দিয়ে বললো, কিরে, খুব না বলতি জীবনেও বিয়ে করবো না। এখন কেন?

যুথী একটু হেসে উত্তর দেয়, নাহ্‌, জাহিদ অন্য সব পুরুষদের মতো না। অন্য কোন মেয়ের দিকে ও তাকায়ই না। সে কথা বাদ দে। কাছেই আমি নতুন একটা বিউটি পার্লার খুলেছি, চল তোকে নিয়ে যাই।

মুনিরার হাতে কোন কাজ নেই, তাই সে আর আপত্তি করলো না। বিউটি পার্লারে গিয়ে ঢুকতেই দেখতে পেল বেশ সুদর্শন একজন পুরুষ বসে আছে। যুথী পরিচয় করিয়ে দিলো, এই হচ্ছে জাহিদ। মুনিরা মনে মনে প্রশংসা না করে পারলো না। পাগলীটা বেশ হ্যান্ডসাম এক হাসব্যান্ড পেয়েছে। রকিব এর সবদিকই ভালো শুধু গায়ের রংটা একটু ময়লা। সেটা নিয়ে মুনিরার মনে একটা গোপন অতৃপ্তি থাকলেও কখনো কাউকে কিছু বলে নি। কিন্তু যুথীর হাসব্যান্ড জাহিদ সত্যিই একজন পছন্দ হওয়ার মতো ছেলে। পুরনো বান্ধবীর সাথে আড্ডা মেরেই সেদিন আসিফ এর স্কুলের সময়টুকু কাটিয়ে দিল মুনিরা।

পরদিন আসিফকে স্কুলে দিয়ে আবার যুথীর বিউটি পার্লারে যায় মুনিরা। সেদিন যুথী ছিলনা সেখানে। বদলে জাহিদ সবকিছু দেখাশোনা করছিল। জাহিদ এর সাথেই কথা বলে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে দিল মুনিরা।

পরদিন আবারো বিউটি পার্লারে গিয়ে উপস্থিত হলো মুনিরা। আজকেও যুথী ছিল না। জাহিদের সাথেই খানিক সময় গল্প করে কাটিয়ে দিল মুনিরা। এভাবেই চলতে লাগলো বেশ কিছুদিন। প্রায়ই বিউটি পার্লারে যুথী থাকতো না। তখন জাহিদ থাকতো। ওর সাথে কথা বলতে বেশ লাগতো মুনিরার। জাহিদেরও যে বেশ ভালোই লাগতো তা মুনিরা পরিষ্কার বুঝতে পারতো।

 

(আগামী পোস্টে সমাপ্য)