দীর্ঘ চার বছরের অপেক্ষার পর এসে গেছে ফুটবল বিশ্বকাপ। যথারীতি বিভিন্ন দলের সমর্থকরা তাদের বাড়ির ছাদে লাগিয়েছেন প্রিয় দলের পতাকা। এক্ষেত্রে অবশ্য ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকরাই এগিয়ে। তবে অন্যরাও কম যান না। কিন্তু আমি যতবারই এই পতাকাগুলো দেখি তখন কেমন জানি হতাশ লাগে। কেন আমাদের নিজের দেশের পতাকা না উড়িয়ে অন্য দেশের পতাকা উড়াতে হয়। আমরা কি নিজের দেশের পতাকা আজ বিশ্বকাপ উপলক্ষে গর্বের সাথে উড়াতে পারতাম না? অবশ্যই পারতাম!
আপনারা নিশ্চয়ই এতক্ষনে হাসতে শুরু করেছেন। ভাবছেন আবারো আমি পাগলের প্রলাপ বকছি। কিন্তু সত্যি বলছি, আসলেও এমনটা হতেও পারতো! বিশ্বাস না হলে বাংলাদেশের র‌্যাঙ্কিংটা দেখুন (Bangladesh: FIFA/Coca-Cola World Ranking)। এখানে দেয়া আছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ১১০ (১৯৯৬ সালে)। এবারের বিশ্বকাপে এবং প্রতি বিশ্বকাপেই এমন অনেক দল থাকে যাদের অবস্থান এর কাছাকাছি এবং ১৯৯৬ সালের দিকে তারচেয়েও খারাপ ছিল। তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন এমন হলো? কেন আমাদের ফুটবলের অবস্থা দিনে দিনে উন্নতির বদলে অবনতি হচ্ছে? এর একটা কারন হিসেবে বলা যায় ক্রিকেট এর ব্যাপক আগ্রাসন। ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অংশগ্রহন করার যোগ্যতা অর্জন করার পর থেকে ফুটবল-এ সেই যে ভাটা পরেছে তা আর কাটেওনি, কাটবেও না মনে হয়! আমার এখনো মনে আছে ছোটবেলায় যখন জাতীয় লীগ এর খেলাগুলো হতো তখন মোহামেডান, আবাহনীর সমর্থকদের সেকি উত্তেজনা। অথচ এখন কেউ তার খবরও রাখে না। দুঃখ দুঃখ!!!
যেহেতু আমাদের দেশ বিশ্বকাপ খেলছে না সেহেতু আমরা বিশ্বকাপে অন্য দেশকে সমর্থন দিতেই পারি। কিন্তু তাই বলে তাদের পতাকা কেন উড়াতে হবে, এটা আমার মাথায় ঢুকে না। এতে একদিকে যেমন আমাদের দেশের আইন ভঙ্গ করা হয় অন্যদিকে অন্য আরেকটি দেশের পতাকাকেও অবমাননা করা হয় (কেননা কোন দেশের পতাকাই সঠিক নিয়ম অনুযায়ী বানানো হয় না এবং সব দেশেরই পতাকার ব্যাপারে বেশ কিছু আইন আছে)। সেই সাথে যে পরিমান কাপড় অপচয় করা হয় তার কথা কি আর বলবো! একটা ছোট্ট হিসাব দিই। ধরুন সারা বাংলাদেশে ১ লক্ষ পতাকা উড়ানো হয়েছে, গড়ে প্রত্যেক পতাকার দৈর্ঘ্য ২ গজ, তার মানে প্রায় ২ লক্ষ গজ কাপড়ের কি নির্লজ্জ অপচয়। আমাদের মতো একটা গরিব দেশে এই কথা ভাবতেও কষ্ট হয়।
ঢাকা নিউমার্কেট এ উড়ছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের পতাকা
কিছুদিন আগে জার্মান প্রবাসী আমার এক বোন তার ফেসবুক-এ স্ট্যাটাস দিয়েছে, “কি খেল! আমার ব্রাজিলিয়ান বান্ধবী তার প্রোফাইল এ ব্রাজিল এর ছবি দেয় নি অথচ বাংলাদেশী বান্ধবী ব্রাজিল এর ছবি লাগিয়েছে।” মনে তখন প্রশ্ন এলো, জাতি হিসেবে আমরা কি কখনোই আত্মসম্মানবোধ অর্জন করতে পারব না?
আমি বিশ্বকাপের সবগুলো খেলা না দেখলেও ভালো দলগুলোর খেলা দেখার চেষ্টা করি। একক ভাবে কোন দলের প্রতি আমার তেমন দূর্বলতা নেই, কোন খেলোয়ার এর খেলা ভালো লাগলে তার খেলাটা দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু যখন বিভিন্ন দলের সমর্থকদের (আসলে অন্ধভক্ত) দেখি তখন তাদের জন্য কেমন যেন করুনা হয়। অনেকেই আছে (সবাই নয়) যারা মনে করে তাদের সমর্থিত দল বাদে অন্য দল যেমন খেলতেই জানে না তেমনি তাদের সমর্থকরাও ফুটবল খেলার কিছুই বোঝে না। এক দলের সমর্থকরা অন্য দলের সমর্থকদের সাথে কথার যুদ্ধ থেকে এক পর্যায়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এমন ঘটনা তো আমদের ইতিহাসে আছেই। যে জাতি অন্যদেশের খেলা নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে তারা রাজনৈতিক সংঘর্ষে লিপ্ত হবে এটাতো খুবই স্বাভাবিক। স্কুল এর কোন এক ক্লাসের বাংলা বইয়ে একটা প্রবন্ধ ছিল (নামটা এখন মনে পরছে না), সেখানে লেখক বলেছেন, “একটি উচ্চ জাতির সংস্পর্ষে আসিয়াও আমরা তাহাদের গুনগুলো রপ্ত না করিয়া দোষগুলো আত্মসাৎ করিয়াছি।” এই কথাটা যে কতোটা সত্য তা বিশ্বকাপ এলেই আরো ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়। কেননা সারা পৃথিবীতে ইংরেজদের খেলা নিয়ে সহিংসতা এবং হুলিগান বিখ্যাত আর আমরা কিনা তাই অনুসরন করছি। এ লজ্জা কোথায় রাখি। তবে এর মাঝেও একটা ভালো খবর দিই, টাঙ্গাইলের কোন এক জায়গায় আমার এক বন্ধু দেখেছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা সেলাই করে লাগানো আর তাতে লেখা, “ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থক মৈত্রী সঙ্ঘ”। এটা দেখে মনে তাও কিছুটা আশার সঞ্চার হয় যে, পতাকা হয়তো তারা টাঙিয়েছে কিন্তু তারা যে সংঘর্ষে যাবে না সে ব্যাপারে তারা ঘোষনা দিয়ে রেখেছে।
জানি আমার এই লেখা পড়ে অনেক অন্ধভক্তই হয়তো নাখোশ হবেন কিন্তু আমি তাদেরকে বলবো, আসুন আমরা খেলা দেখি, সবাই মিলে এর মজা নিই, অন্যদের সাথে তর্ক করি কিন্তু তা যেন গঠনমূলক হয় এবং কাউকে আঘাত না করে। নিজের দেশের সম্মান বজায় রাখি, অন্যদেশকেও সম্মান করি। আর সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশকে কি করে বিশ্বকাপে দেখা যায় তার স্বপ্ন দেখি এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করি।

Bookmark and Share